জন্মকুন্ডলীতে রাহুর কোন অবস্থান ভালো হয়?
- anirudhbhattachary5
- Feb 2
- 4 min read
আমি প্রায়ই এমন প্রশ্ন পেয়ে থাকি যেখানে মানুষরা তাদের চার্টে কোনও গ্রহের অবস্থানকে "ভাল" বা "খারাপ" হিসেবে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করে। যদিও এটি স্বাভাবিক যে মানুষরা গ্রহের অবস্থানগুলি সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ধারণা শোনে এবং সেগুলিকে নিজেদের জন্য মান্য করে, তবে এটি একেবারে সঠিক নয়। কোনও গ্রহের প্রকৃত পরিস্থিতি ও প্রভাব কেবল তার পুরো জন্মকুণ্ডলি দেখেই বোঝা যায়।
রাহু-কেতুর সৃষ্টি নিয়ে পৌরাণিক কাহিনী
বিষ্ণু পুরাণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রগুলিতে বর্ণিত রাহু-কেতুর কাহিনী খুবই পরিচিত। পৌরাণিক মতে, দেবতারা এবং দানবরা (অসুররা) চিরকালীন শক্তিশালী, অমরত্বের জন্য অমৃত প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মহাসাগর মন্থন করেছিলেন। কিন্তু তারা একে অপরকে সাহায্য না করলে সাগর মথন সম্ভব ছিল না, তাই ভগবান বিষ্ণুর পরামর্শে তাদের দানবদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। মহাসাগর মন্থনের জন্য তারা মন্দার পর্বতকে দন্ড হিসেবে এবং সাপ বাসুকিকে, যিনি সাধারণত শিবের গলায় জড়ানো থাকেন, রশি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
মন্থনের সময় প্রথমে প্রচুর 'হলাহল' বিষ বের হয়, যা মহাদেব শিব গ্রহণ করেন এবং পৃথিবীকে রক্ষা করেন। পরে সাগর মন্থনের মাধ্যমে অমৃত এবং নানা ধরনের রত্ন বের হয়, যা দেবতারা এবং অসুরদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
ভগবান বিষ্ণু মোহিনী রূপে আবির্ভূত হন এবং দেবতাদের অমৃত পান করান। তবে একটি দানব, স্বরভানু, দেবতার রূপ ধারণ করে এবং অমৃত পান করে। যখন তা তার গলায় পৌঁছায়, তখন ভগবান বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে তার মাথা কেটে ফেলেন। এরপর তার দেহ দু’ভাগে বিভক্ত হয়। একটি হলো মাথা এবং বাকি অংশ তার দেহের। শুধু মাথা রাহু হয়ে ওঠে, আর দেহের বাকি অংশ কেতু হয়ে থাকে। এই দুইটি সর্বদা ১৮০° ব্যবধানে থাকে। আমাদের এই ১৮০° বা বিপরীত মুখী হওয়ার মহত্ত্ব আমাদের বুঝতে হবে।
এই কাহিনীর গভীর অর্থ
এখানে দেবতারা তাদের নৈতিক গুণাবলীর দ্বারা অমরত্ব এবং অসুররা চিরকালীন শক্তি এবং ক্ষমতার জন্য অমরত্বের লড়াই করছে, তবে তারা কখনোই নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে চিন্তা করেনি। জীবনকেও সাগরের মতই দেখা যায়—এতে ভাল এবং খারাপ উভয়ই মিশে থাকে। কাহিনীটি বলে, যখন আমরা জীবনচক্রে পা রাখি, তখন আমাদের নৈসর্গিক ভাব থাকে: ঈশ্বরীয় গুণাবলী অনুসরণ করা, নাকি অশুভ ইচ্ছা দ্বারা চালিত হওয়া।
মন্থনের প্রক্রিয়াটি জীবনের সংগ্রামকে প্রতীকিত করে, যেখানে অশুভ ও শুভ গুন আমাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত।আমাদের পরিস্থিতি, পরিবেশ, সংস্কার ও শিক্ষার দরুন বা এর প্রভাবে আমরা বাইরের পৃথিবীতে তার প্রতি আকৃষ্ট হই। কিন্তু আমাদের মানসিকতা সেটাকে আমাদের উচিত বলে ভ্রমিত করে। এটা আবশ্যক নয় যে আমরা শুধু অন্যদের জন্য খারাপ চিন্তা করি। আমরা নিজের জন্য অতীব লোভী অথবা নিজেদের পরম আদর্শ বলে ভ্রমিত হতে পারি। সেই অর্থে দানব ও দেবতা আমাদের মধ্যেই আছে। আমাদের মধ্যের দানবও দেবতার রুপ ধারণ করে মোহের বশে বিভ্রান্ত থাকতে পারে। আমরাও আমাদের পরম আকাঙ্ক্ষার বস্তু অর্জনের যোগ্যতার বিবেচনা না করেও তার চরম আকাঙ্ক্ষা করতে পারি।আমরা ভুলে যাই যে ভালো ফল পেতে প্রথমে কঠিন সময় আসবে, কিন্তু পরিশেষে সেই কঠিন সময় শিবের দ্বারা রূপান্তরিত হয়।
বিষ্ণু অসুরদের বলেন যে তারা মন্থন করার সময় বসুকির লেজের দিকটা ধরুন এবং ডানদিকে থাকুন, আর দেবতারা বামদিকে থাকুন এবং মুখের দিকটা ধরুন। কিন্তু দানবরা তা অস্বীকার করলেন এবং সর্পের মুখের দিকটা ধরলেন। সর্পের মুখ হলো রাহু, লেজ হলো কেতু এবং মধ্যের ভাগ হলো শনি। তাই শনি হলেন কর্মের ভাগে, মন্থন দন্ডকে ধরে আছেন। কিন্তু তারই এক ভাগে রাহু ও এক ভাগে কেতু।

আজকের যুগে সাধারণত সামাজিক মাধ্যমে রাহু সংক্রান্তে কোনো লেখা থাকলে, তাতে যদি ছবি থাকে, তাহলে সবাই তাতে একটি দানবের ছবি দিয়ে থাকে, যে খুব হিংস্র। অথচ রাহুর যা বর্ণনা আমরা পাই, তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ রাহুর চেহারা এই প্রতিকী ছবির মতন হতে পারে।
স্বরভানুর প্রতারণা এবং তার মাথা কেটে ফেলা মানে হল যে আমরা প্রায়ই আমাদের ইচ্ছা এবং বিভ্রমের দ্বারা পরিচালিত হই। মাথা (রাহু) আমাদের মন এবং ইন্দ্রিয়গুলির প্রতিনিধিত্ব করে, যা ক্রমাগতঅর্জন বা প্রাপ্তির মাধ্যমে পূর্ণতা খোঁজে কিন্তু কখনও সন্তুষ্ট হয় না। দেহ (কেতু) আমাদের পুরনো কর্মের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং বিগত সময় ও জীবনের কর্মগুলি যার ফলাফল অপ্রাপ্ত তা নিয়ে আমাদের অনুসরণ করে। সে সেই কর্তাকে খুঁজছে যে সেই কর্মের ফলাফলের ভুক্তভোগী হয়নি। যে সেই ইচ্ছা করে, কর্ম করেছিলো, কিন্তু তার পরিণাম এখনো ভোগ করেনি। তার আগেই আবার নতুন ইচ্ছায় মগ্ন হয়েছে।
তাহলে কেতু হলো আমাদের সেই কর্ম যা আমরা করেছি, কিন্তু তার ফলাফল ভোগ করা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সেই অর্থে সে দেহ। কিন্তু তার পা নেই। সে সর্পের মতন পূর্বকাল থেকে চলে আসছে। কুন্ডলীর যেই ঘরে রাহু সেই বিষয়ের প্রতি আমরা চরমে আগ্রহী, আকর্ষিত। সেটা আমরা চাই। আর কেতু যেখানে অবস্থিত তা আমরা চাই না। সেই ভাব জনিত কর্ম আমরা প্রচুর পরিমাণে পাই, তার নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হই, কিন্তু তা আমাদের ভালো লাগে না। যেই কর্ম করতে আমাদের চরম অনীহা কিন্তু তার থেকে আমরা চাইলেও মুক্ত হতে পারি না তা হলো কেতু জনিত কর্ম। অনেক সময় আমরা কিছু কিছু কাজে আশ্চর্যজনক ভাবে জন্মগত দক্ষতা নিয়ে জন্মাই। তা কেতু গ্রহের সাথে সম্পর্কিত। এমন কিছু যা আমরা বিগত জীবনে অনেক বেশী করেছি, কিন্তু সেই সঙ্ক্রান্তে, বা তার ফলাফল উপলব্ধি করা এখনও অসম্পূর্ণ।
রাহু বোঝার জন্য জ্যোতিষী দৃষ্টিভঙ্গি
প্রথমেই বলতে হয়, কোনও গ্রহের অবস্থানকে এককভাবে ভাল বা খারাপ বলা উচিত নয়। কোনো গ্রহ যে কোন ঘরে ভাল বা খারাপ ফল দিতে পারে, তা পুরো কুণ্ডলির অন্যান্য গ্রহগুলির অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। একে শুধুমাত্র ঘরের অবস্থান দেখে “সেরা” বা “খারাপ” হিসাবে চিহ্নিত করা ভুল। এরজন্য পুরো কুণ্ডলি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তবে, জ্যোতিষের নিয়ম অনুযায়ী কিছু গ্রহের অবস্থান বিশেষ কিছু ঘরে ভাল বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাহু ৬ষ্ঠ, ৩য়, ১১তম এবং করে,যদিও ১০ম ঘরেএর ভাল অবস্থান বলে মনে করা হয়। তবে, এটি সম্পূর্ণ পরিদৃশ্য নয়। ১১তম ঘরে রাহু বৃহস্পতির শক্তি দুর্বল করে দিতে পারে। ৩য় ও ৬ষ্ঠ ঘরে রাহু, বুধের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। এমনিতেও, রাহু সবসময় বুধেরর অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। এমন অনেক অন্যান্য অবস্থা এবং গ্রহযোগ-ফল থাকতে পারে, যার কারণে রাহু ৬ষ্ঠ বা ৩য় ঘরেও খারাপ ফল দিতে পারে।
যেমন: যদি রাহু ৬ষ্ঠ ঘরে থাকে এবং কুন্ডলীতে সূর্য-শনি যোগ থাকে, তবে রাহু খারাপ ফল দিতে পারে। আবার, যদি শুক্র বুধের পিছনে (অর্থাৎ পিছিয়ে) থাকে, তাহলে রাহু খারাপ ফল দিতে পারে।
রাহুর জন্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থান হিসেবে ৮ম ও ১২তম ঘরে দেখা হয়। এই ঘরের প্রকৃতির সাথে রাহুর প্রকৃতির সম্পর্ক রয়েছে, তাই এর ফলে খারাপ প্রভাব আরও বাড়ে। তবে অন্য গ্রহগুলির অবস্থা নির্ভর করে কিছু প্রভাব নরমও হতে পারে।
রাহুর প্রথম ঘরে অবস্থান সাধারণত খারাপ বলে ধরা হয়। তবে, যদি সেখানে মেষ রাশির অবস্থান থাকে, তাহলে রাহু বয়স বাড়ার সাথে সাথে খারাপ প্রভাব ফেলবে না। তবে, সূর্য যেখানে থাকবে সেই ভাবের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
এই হল কয়েকটি উদাহরণ। এর আরও অনেক পরিস্থিতি থাকতে পারে যা রাহুর ফলাফলকে উভয় দিক থেকে পরিবর্তিত করতে পারে।আমরা প্রায়ত সবাই জানি যে রাহু চতূর্থ ঘরে খুব খারাপ। কিন্তু যদি সেই জাতকের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভাবে কোনো গ্রহ না থাকে, তাহলে এই রাহু অত্যধিক ভালো ফলাফল দিতে পারে। যদিও অনান্য বিষয় বিবেচ্য।সুতরাং, গ্রহের অবস্থানকে শুধুমাত্র বইয়ের লেখা শব্দের হিসেবে নেওয়া উচিত নয় এবং তার অনুযায়ী একে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী বা সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত হিসেবে নেওয়া উচিত না
আপনি যদি আপনার কুন্ডলীতে রাহুর অবস্থান বুঝতে চান, আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন আমরা আপনাকে সম্পূর্ণ জন্মকুণ্ডলি ভিত্তিক বিশ্লেষণ দিতে পারি।
Comentários